শনিবার, ৫ জুলাই, ২০১৪

আট কুঠুরী নয় দরজার নিগুঢ়তা- লালন শাহ্‌

সমস্ত প্রাণিজগতকে মোটা দাগে দুভাগে ভাগ করা যায় মেরুদণ্ডী অমেরুদণ্ডী। এই মেরুদণ্ড প্রাণির বিবর্তনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। মেরুদণ্ডের কশেরুকার ভিতর দিয়ে তিনটি স্নায়ু পেচিয়ে পেচিয়ে (কুণ্ডলী স্ত্রীবাচক কুণ্ডলিনী) মাথায় গিয়ে মিলেছে।যা ভারতীয় তান্ত্রিকদের কাছে অনেক সময় ত্রিবেণী নামেও পরিচিত। সুষুন্মা, ইড়া, পিঙ্গলা। সুষুন্মা অক্ষের মতো যাকে পেচিয়ে বাকি দুটি। ইড়া বাম শুক্রাশয় থেকে ডান নাসারন্ধ্র পর্যন্ত। শ্বেত বর্ণের শান্ত সৌম্য ও চাঁদের সাথে তুলনীয়। পিঙ্গলা (লাল) ডান শুক্রাশয় থেকে বাম নাসারন্ধ্র পর্যন্ত বর্ধিত যা ভয়াবহ শক্তিশালী ও সূর্যের সাথে তুলনীয়। ত্রিবেণীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্তরে স্তরে বিভিন্ন কুঠুরী বা পদ্ম ফুলের বর্ণনা করা হয়েছে। পদ্ম গাঙ্গেয় অঞ্চলের খুব সাধারণ ফুল এবং প্রচুর মিথ আছে এই পদ্ম নিয়ে। ব্রহ্মা স্বপ্নে দেখেন তার নাভিমূল থেকে পদ্ম ফুল ফুটে। স্বরস্বতী পদ্মফুলের উপর আবির্ভূত হন। প্রাণির দেহে ফুলের সনাক্তকরণ যারা গ্রামে থাকেন তারা সহজেই করতে পারবেন। গরু ছাগলের বাছুর হওয়ার পর লোকজন পাহাড়ায় থাকে যেন ফুল না খেয়ে ফেলে। গরু তৃণভোজী কিন্তু এই আমিষ জাতীয় খাদ্য সরিয়ে না ফেললে সে অবশ্যই খায়। লালন তার গানে সরাসরি ফুল শব্দটিও ব্যবহার করেছেন।



কমল কোঠা কারে বলি
কোন মোকাম তার কোথা গলি
সেইখানে পড়ে ফুলিমধু
খায় সে অলি জনা।

কিংবা

এক ফুলের মর্ম জানতেহয়
যে ফুলে অটল বিহারী
বলতে লাগে ভয়।

একমাত্র খুঁটি সুষুন্মার শুরু থেকে শেষ অবধি কুণ্ডলিনীর (ত্রিবেণী) বিভিন্ন স্তরে সাধনার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন চৈতন্য জাগ্রত করে শেষে ঈশ্বরের সাথে লীন হওয়াই দুনিয়ার সমস্ত সাধকের উদ্দেশ্য। সাধকের রূপান্তরের এই স্তর বা চক্র বা ফুল বা কুঠুরী বা আসমান উপমায় কখনও সাত কখনও আট বা নয় ধরনের স্তরের কথা বলা হয়ে থাকে। লালন ৭, ৮, ৯, সবই ব্যবহার করেছেন-

মানুষ-মক্কা কুদরতি কাজউঠছে রে আজগুবি আওয়াজ সাততলা ভেদিয়ে।আছে সিং দরজায় একজন দ্বারী নিদ্রাত্যাগী হয়ে।।

অথবা-
মূলাধার কুঠুরী নয়টাতার উপরে চিলেকোঠাতাহে এক পাগলা বেটাবসে একা একেশ্বরে।

ভারতীয় মিথে সাধনার এই স্তরসমূহকে মূলত সাত চক্রেই আলোচনা করা হয়েছে। কোথাও বা উপবিভাগ করেছে আট বা নয় চক্রে। সুষুন্মার ভিত্তি বা মূলকে বলা হয় মূলাধার চক্র। মূলাধারের অবস্থান যৌনাঙ্গ ও পায়ু পথের মাঝে। চিত্রে বৃত্তের ভিতর চতুর্ভূজের দ্বারা বুঝানো হয়েছে পার্থিব বিষয় আশয়। হাতির পিঠের উপর নিন্মগামী ত্রিভূজ দ্বারা যোনী তথা বিশ্বমাতা, এর মাঝখানে পুরুষ প্রতীক শিবলিঙ্গ যাকে সাড়ে তিন প্যাচে জড়িয়ে সর্প দেবী কুণ্ডলিনী। এবার আসা যাক হাতির কথায়। হাতি ভারতে একটি মিথিক চরিত্র। মিথ অনুসারে ‘একদা হাতি মেঘের মতো রূপ পরিবর্তন করতে পারতো, উড়তে পারতো। একদিন সে উড়ে গিয়ে বসলো এক ডালে। ঐ গাছের নীচে এক সাধু তার শিশ্যদের পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় ডাল ভেঙ্গে কয়েকজন শিস্য মারা গেল আর হাতি সুন্দর উড়ে গিয়ে বসলো অন্য ডালে। সাধু সাথে সাথে রেগে গিয়ে সমস্ত হাতি জাতিকে অভিশাপ দিলেন। হাতি তার রূপ পরিবর্তন ও উড়ার ক্ষমতা হারালো। এর পর থেকে হাতি পৃথিবীতে হেঁটে চলা একখণ্ড অভিশপ্ত মেঘ।’ হাতির এই সিম্বল থেকে বুঝা যায় শর্তমুক্ত হলে সহজেই পৌছা যায় পরবর্তি কুঠুরীতে। মূলাধার স্তর সাধকদের কাছে খুবই স্থুল পর্যায়। এর দ্বারা পরিচালিত মানুষজন সক্রিয় নয়।

পরের চক্র স্বাধিষ্ঠান:



এটি কুণ্ডলিনীর বিশেষ আবাস। শরীরের যৌনাঙ্গ বরাবর এর অবস্থান। এই চক্রে কুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয় যৌনতা। চিত্রে পানির অসুর মকর এর প্রধান উপাদান। ফ্রয়েড জীবনের এই চক্রের আলোচনা করেছেন ভালোভাবে। ভারতীয় সাধকেরা এই কুঠুরী উত্তরণের ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত। একটি ধারা কামকে হ্যা বলেছে অন্যটি না। বাউলরা প্রথমটি।

৩য় তলা হলো মনিপুর:



নাভির স্তরে এর অবস্থান। মানুষের ভোগবাদীতা, দখল মনোবৃত্তি ইত্যাদির প্রকাশ এখানে। উল্লেখিত চক্রসমূহ সাদামাটা। যারা এর মধ্যে জীবন যাপন করে তাদের জাগতিক চাওয়া পাওয়াই নির্ধারণ করে জীবনের সুখ-দুঃখ। এরা নিষ্ক্রিয় অথবা প্রতিক্রিয়াশীল। পরবর্তি চক্র সমূহ উঁচু স্তরের। অনেকটা শরিয়ত-মারিফতের পার্থক্যের মতো। দান্তের মতে নতুন জীবনের শুরু।

চক্র চারঃ অনাহতঃ




হৃদপিণ্ডের বরাবর এই পদ্ম। অনাহত মানেই আঘাতহীন। আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা হলো আঘাত ছাড়া শব্দ অসম্ভব। কিন্তু বিজ্ঞানের Big Bang আল্লার কুন বা ভারতের ওঁম এই সব শব্দ আমাদের চেনা বস্তুর আগে। সাধকেরা চিরন্তন সেই আঘাতহীন শব্দ শোনার সাধনা করে। রাবেয়া বসরী বলেছেন নৈশব্দই সেরা ইবাদত। তিনি নদীর পাড়ে বসে এই সাধনাই করতেন। অনাহত শব্দ শুনার পরে পরবর্তি কুঠুরীতে গমন।

চক্র পাঁচ বিশুদ্ধ:



এর অবস্থান গলায়। কুণ্ডলিনী যখন এই তলে পৌঁছা্য় তখন সাধকের সাথে ঈশ্বরের কথাপকথোন হয়। চিত্রে নিন্মমূখী ত্রিভূজের ভিতর পূর্ণ বৃত্ত হলো পূর্ণ চন্দ্র। লালন তার বহু গানে বলেছেন এই চাঁদের কথা। এখানকার দেবতা হলো অর্ধনরেশ্বর শিব। সাধকেরা দেখতে পান পারে যাওয়ার তরী। লালন অসংখ্য গান লিখেছেন পারাপার তত্ত্বের। চির মুক্তি লাভের এই যাত্রা খুবই বিপদ সংকুল। সিদ্ধ পুরুষ হতে আর দু চক্র বাকী।

আজ্ঞা। ষষ্ঠ চক্র:



দুই ভ্রুর মাঝে উপরে মেয়েরা যেখানে টিপ পড়ে সেখানে এই চক্রের অবস্থান। সূফীদের ফানা ফিল্লা্হ বা ঈশ্বরের সাক্ষাৎ বা দিদার। রামকৃষ্ণের বর্ণনায় এ স্তরে কিছুটা আমিত্ব বা (Ego) থেকে যায়। তিনি বলেন এ যেন ঠিক কাঁচে ঘেরা বাতি। সবই দেখা যায় তবু থেকে যায় বাঁধা।

সহস্র। ৭ম চক্র:





এই স্তর হলো বাকা বিল্লাহ। মনসুর হাল্লাজের ‘আনাল হক’ বা আমিই সত্য। রামকৃষ্ণের বর্ণনায় কোন ধরণের বাঁধার অস্তিত্ত্ব নেই। শুধুই আলোর ঝলকানী। লালনের মতে দিবা রাতি নাই সেখানে। লালনের গানে দেখুন সহস্রের কথা-

যে রূপে সাঁই বিরাজ করে দেহ ভুবনে
গুরুর দয়া যারে হয় সেই জানে।
শহরে সহস্র পারা তিনটি পথ তার এক মহেরা
আলেক সওয়ার পবন ঘোড়া ফিরছে সেখানে।
গুরুর দয়া যারে হয় সেই জানে।

সহস্রের উপরে চিলে কোঠায়ই পাগলা বেটা থাকেন। এরপর লালন বলেন,

উপর নিচে সারি সারি
সাড়ে নয় দরজা তারি।
লালন কয় যেতে পারি
কোন দরজা খুলে ঘরে।

সাড়ে নয় দরজা বলতে দুই চোখ, দুই কান, দুই নাক, মুখ, যৌনাঙ্গ, পায়ু। যৌনাঙ্গে নারীর দুই দরজা পুরুষের একটা গড়ে সাড়ে নয়।
(সংগ্রহঃ- লালনগীতি)

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 

Blogger news

Blogroll

About