শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৪

বস্তু এবং বুদ্ধিবৃত্তি

জন্ম পক্রিয়ায় প্রাণীয় সত্ত্বাগুলো যান্ত্রিক প্রোডাক্টের অনুরূপেই পৃথিবীকে জানান দেয় তার উপস্থিতি। সত্ত্বাকে মানবরূপে গড়ে তুলতে অনেকটা সাহায্য করে সামাজিকীকরণ। প্রকিৃতির সত্ত্বাগুলোর মধ্যে পার্থক্য করতে বস্তুগত প্রক্রিয়া থেকে জ্ঞানগত কাঠামোকে অধিক মূল্যায়ন করেই সত্ত্বার উপর গুন আরোপ করা হয়। তাকে ভাগ করা হয় বিভিন্ন শ্রেণীতে যেমনঃ মনুষ্যসত্ত্বা, পশুসত্ত্বা ইত্যাদি। মানুষ যখন তার ওরিজিনকে অস্বীকার করে কেবলমাত্র বস্তুগত  সত্ত্বায় নিজেকে রূপান্তরিত করে তখন তার মধ্যে আর মনুষ্যস্পৃহা থাকে না। তার সাথে প্রাণীয় আচরণের যোগসূত্রই তাকে মনুষ্যসত্ত্বা থেকে বিচ্যুতি ঘটায়। তাই প্রত্যেক মানব সত্ত্বার উচিৎ স্প্রিচুয়ালিটিকে কেন্দ্র করে জীবন পরিচালিত করা। মানুষ যেহেতু একটি পবিত্র সৌল থেকে উদ্ভূত সেহেতু তার উচিত জ্ঞানীয় কাঠামোকে প্রাধান্য দিয়ে বস্তুগত সমিৃদ্ধিকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা। বস্তু সবসময় মানবীয় গুনাবলির উল্টো দিকে অবস্থান করে। মানুষের যখন বস্তুপ্রীতি বেড়ে যায় তখন সে মানবীয় গুনাবলির বিরুদ্ধাচারন করে।

সামাজিকীকরণ এ’ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে। লুকিন গ্লাস সেলফ থিওরিতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় মানুষ সব সময় নিজেকে সমাজের চোখে দেখতে চায়, আর সেখানে সমাজ কাঠামোটা যদি বস্তুবাদী হয় তখন মানুষ স্রোতের তালে নিজেকে হারিয়ে ফেলে বস্তুবাদী জীবন যাপন করতে থাকে। এর থেকে উত্তোলনের জন্য মানুষের একমাত্র উপায় হচ্ছে রেশনাল হওয়া, তার আত্মিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করা।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও আমাদেরকে চরম ভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক/বস্তুবাদী করে তোলে। ২০০ বছর ইংরেজ উপনিবেশ ফলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে উপনিবেশিক কাঠামো তৈরি হয়েছে, সেই শিক্ষা ব্যাবস্থায় বিদ্যা অর্জন করে আমরা কেবল মাত্র পুঁজিবাদের শ্রমের প্রোডাক্টই তৈরি হচ্ছি। আর আমাদের মূল্যবোধ দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ হয়ে যাচ্ছি বুদ্ধিভিত্তিক দালাল, কেউবা সাধারণ শ্রমিক। সমাজের এমন কাঠামোকে মেনে নিলে আমরা কেবল কেবল বুর্জুয়া শ্রেণীর পুঁজির একটা হাতিয়ার হিসেবে তৈরি হব। আমরা আমাদের উপনিবেশিক চিন্তা মুক্ত হয়ে নতুন ধারা সৃষ্টি করতে হবে, যেটা পরিচালিত হবে মূল্যবোধ, বুদ্ধিবিত্তি দ্বারা। জ্ঞানই শক্তি আমাদের এই শ্লোগানটি সবার কাছে পরিচিত করতে হবে।
বিংশ সতাব্দিতে ইউরোপে স্প্রিচুয়াল জ্ঞান বিমুখ বর্বর সময় যখন এগিয়ে যাচ্ছিল তখন কিছু আত্মা সর্বস্ব মানুষ জেগে উঠেছিল এবং ফ্রিডরিখ নীটশে, জঁ-পল সার্ত্র্, মার্টিন হাইডেগারদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল নতুন সম্ভাবনা তত্ত্ব অস্তিত্ববাদ। যেখানে মনে করা হয় মানুষ এনিমেলের মত বস্তুগত সত্ত্বা নয় তাদের নিজস্ব একটা সত্ত্বা আছে যেটাকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজের ব্যক্তি সত্ত্বাকে বিকশিত করে। কারণ বস্তুবাদের ফলে মানুষের মূল্যবোধ হারিয়ে যাওয়ায় বস্তুগত উন্নতির লক্ষ্যে তারা নানা ধরনের অন্যায় কাজকে পরিচালনা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।  তাই মানুষের মধ্যকার সামজিক নিরাপত্তাহীনতা, ভয় উৎকন্ঠাজনিত ইত্যাদি সমস্যার কথাকে অস্তিত্বের সংকট বিবেচনা করে অস্তিত্ববাদ। পরবর্তীতে অস্তিত্ববাদও আত্মা সর্বস্ব মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলে। সাঁৎরে তার বিং এন্ড নাথিংনেস গ্রন্থে সত্ত্বার সর্বাত্মক স্বাধীনতার কথা বলেন, যেটাতে সামষ্টিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়। যেহেতু মানবিক সত্ত্বা একটি শৃঙ্খলিত নির্ভরতা সূত্রে আবদ্ধ। আর স্বভাবতই মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হতে পারেনা। কারণ দুই বা ততোধিক আত্মা মিলে একটি নতুন সত্ত্বার সৃষ্টি করে যেটি হয়ত নতুন গুনে গুণান্বিত। যদি সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি তার সতন্ত্র ইচ্ছার উপর কর্তৃত্ব চালায় তখন সমঝোতার পথ অবরুদ্ধ হয় এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। মানুষের অন্যের প্রতি ভালবাসা, সম্প্রিতি, সহযোগিতা, আইনের অবক্ষয় তৈরি হয়। মোট কথা সমাজ পরিণত হয় দ্বন্দ্বাত্তিক একটি কাঠামোতে।
আর তাই প্রয়োজন নৈতিক জ্ঞান যার মাধ্যমে মানুষ সততা এবং মানবিকতাবোধ জাগাতে পারবে। যার দ্বারা মানুষের অধিকার রক্ষা করা যাবে। যেখানে দেবতা প্রোমিথিউস জ্ঞানের উৎকর্ষতাকে প্রাধান্য দিয়ে, জিউসের নিষেধ অমান্য করে মানুষের জন্য অগ্নি (জ্ঞান) চুরি করে নিজে শৃঙ্খলিত হয়েছেন। সেখানে আমাদের জ্ঞানের প্রতি এত অনীহা সত্যি বেদনাদায়ক। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি আয়াতে জ্ঞান, যুক্তি বিচার বিশ্লেষণের কথা বলা হয়েছে সেখানে আমরা কেন জ্ঞান বিমুখ !!
তাই আমাদের প্রয়োজন বস্তুকে পেছনে ফেলে নিজের পবিত্র যৌক্তিক সত্ত্বাকে প্রাধান্য দেয়া। একাডেমিক জ্ঞানের পাশাপাশি বহিঃ জ্ঞানের ধারাকে অব্যাহত রাখা। ফলতই আগামীতে তৈরি হবে এক যুবক শ্রেণী যারা বস্তু নয় জ্ঞানের গুনেই গুণান্বিত, যারা ট্যাকনোরেশনাল নয় রেশনালিটিকেই টেকনো খাতে ব্যবহার করবে। তাহলেই সমাজ সামনে এগিয়ে যাবে। নিশ্চয়ই রাতের পর’ই দিন আসে, কষ্টের পর’ই সুখ আসে। আমরা নতুন ভোরের প্রত্যাশায়…

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 

Blogger news

Blogroll

About